ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত—এ তিন মাসে সাতটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। খুন হয়েছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কিশোর ও যুবক। এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, পূর্ববিরোধ, পারিবারিক বিরোধ, তুচ্ছ ঘটনায় মারধর, আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, অর্থ লেনদেনের ঘটনা বা প্রতিপক্ষের হামলায়।
বিষয়টিকে উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছে সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (সরাই সার্কেল) রকিবুল হাসান বলেন, এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে দাঙ্গা চলে আসছে। ছোটখাটো ঘটনায় মানুষ গোষ্ঠীগত দাঙ্গায় জড়িয়ে যাচ্ছে, ফলে খুনের ঘটনা ঘটছে। এসব থেকে বের হয়ে আসতে তরুণ সমাজকে সচেতন হতে হবে। তাঁদেরকে কাউন্সিলিং করতে হবে। আর যাঁরা সমাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদেরকে সচেতন হতে হবে এবং সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তাঁদের নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। দাঙ্গা–ফ্যাসাদ নিরসন করা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এসব নিরসনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার উপজেলার শাহজাদাপুর ইউনিয়নের শাহজাদাপুর গ্রামে খাসজমির ধানকাটা নিয়ে একটি গ্রামের দুই দলের সংঘর্ষে দেশি অস্ত্রের আঘাতে খুন হন কামাল উদ্দিন (৫৫) নামের এক ব্যক্তি। এ সময় পুলিশের ছয় সদস্যসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক বাসিন্দা। এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। এই মামলায় পুলিশ ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। গ্রামছাড়া হয়েছে শত শত নারী-পুরুষ। গবাদিপশু ও সহায় সম্পদ হারাচ্ছে বহু পরিবার।
এর আগে গত শুক্রবার রাতে উপজেলার পাকশিমুল ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে প্রতিপক্ষের মারধরের শিকার হয়ে নিহত হন বাচ্চু মিয়া (৫৫) নামের এক ব্যক্তি। জানা যায়, বাচ্চু মিয়া গ্রামে মুদিদোকানের ব্যবসা করতেন। গত বছরের আগস্টে হরিপুর গ্রামে হাফিজ মিয়া (৪৭) নামের এক ব্যক্তি প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘানে খুন হন। এরপর বাচ্চু মিয়ার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। ঘটনার পর বাচ্চু মিয়া এলাকা ছাড়েন। মাসখানেক আগে বাচ্চু মিয়া এলাকায় ফেরেন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁর দোকানে একই গ্রামের আরমান মিয়ার পূর্বের বকেয়া ছিল চার হাজার টাকা। ওই বকেয়া টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে শুক্রবার রাতে আরমান মিয়া ও তাঁর লোকজনের হামলার শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান বাচ্চু মিয়া।
গত ৩০ মার্চ রাত ১০টার দিকে উপজেলা সদরের বড্ডাপাড়া এলাকায় গ্রামীণ সড়কে খুন হন সারোয়ার মিয়া ওরফে লাল খাঁ (৩০) নামের এক যুবক। তিনি সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নের খাঁটিহাতা গ্রামের আবুল কালাম মিয়ার ছেলে। তিন বন্ধু মিলে চুরি করা ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশা বিক্রির টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে দুই বন্ধু ছুরিকাঘাত করে খুন করেন সারোয়ারকে। এমনটাই স্বীকার করেন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সারোয়ারের দুই বন্ধু আল আমিন ও জসিম উদ্দিন।
২৪ মার্চ সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই আঞ্চলিক সড়কের ধর্মতীর্থ এলাকায় অটোরিকশা ছিনতাইকারী চক্রের হামলায় গুরুতর আহত হন উপজেলা সদরের সৈয়দটুলা গ্রামের বাসিন্দা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক আব্বাস আলী (৫২)। ওই দিন ছিনতাইকারীরা তাঁর অটোরিকশাটিও নিয়ে যান। ২৬ মার্চ রাতে তিনি জেলা সদর হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। রিকশাটিও উদ্ধার হয়নি।
৬ মার্চ নিখোঁজ হন কালীকচ্ছ ইউনিয়নের বিশুতারা গ্রামের আবুল কালামের স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৭০) নামের এক বৃদ্ধা। পরদিন গ্রামের একটি খাল থেকে পুলিশ ওই নারীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে। ওই নারীর শরীরের একাধিক স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পায় পুলিশ। পুলিশের ভাষ্যমতে, পূর্ববিরোধ বা পারিবারিক বিরোধের জেরে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এ ঘটনায় হত্যা মামলা হলেও এখনো ঘটনার রহস্য অজানাই রয়ে গেছে।
গত ১৮ জানুয়ারি উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের জাহিদুল ইসলাম ওরফে পরশ (১৭) নামের এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রামের একটি বাড়ি থেকে সেচপাম্প চুরির অভিযোগে মারধরের পর ওই কিশোরের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বলে পরিবারের লোকজনের অভিযোগ ছিল। পরে গ্রাম্য সালিসে অর্থের বিনিময়ে ঘটনা শেষের পথে চলে যায়।
১০ জানুয়ারি পারিবারিক কলহের জেরে মারধরের শিকার হয়ে উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের ইসলামাবাদ গ্রামের ছিদ্দিক মিয়া (৫২) নামের এক ব্যক্তি খুন হন। এ ঘটনায় হত্যা মামলা হলেও গ্রাম্য সালিসে ২০ লাখ টাকায় ধামাচাপা দেওয়া হয় ওই খুনের ঘটনা। সরাইলে তিন মাসে সাতটি খুনের ঘটনাকে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করেছেন সরাইল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মৃধা আহমাদুল কামাল। বলেন, খুন ও দাঙ্গা–হাঙ্গামা বৃদ্ধির জন্য দুর্বল সামাজিক সালিসি প্রথাই দায়ী।
prothomasha.com
Copy Right 2023