তিন মাস আগে রাজধানীর হাজারীবাগে ভাড়া বাসায় খুন হন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায়ী তানিয়া আক্তার (৩৫)। দুদিন পর তাঁর গলাকাটা লাশ উদ্ধার হয়। পরে তদন্তে নেমে এই ঘটনায় একটি বাহিনীর মধ্যম সারির একজন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। তাঁকে এই মামলায় হেফাজতে পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তানিয়া হাজারীবাগের মিতালী রোডের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। জানুয়ারির শুরুতে ওই বাসায় ওঠেন এবং ১৯ জানুয়ারি নিজ কক্ষে খুন হন তানিয়া। এরপর ২১ জানুয়ারি তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় ফ্ল্যাটের মালিককে। পরে তদন্তে উঠে আসে, এ ঘটনায় মো. কুদ্দুসুর রহমান নামে সেনাবাহিনীর একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা জড়িত। নিহত তানিয়ার ভাই ও মামলার বাদী মো. তন্ময় হাসান গত রোববার বলেন, বোন খুন হওয়ার কিছুদিন পর তাঁরা জানতে পারেন, এই ঘটনায় ওই কর্মকর্তা জড়িত। তিনি বলেন, ‘হয়তো আমার বোনের কাছে ওই কর্মকর্তার এমন কোনো তথ্য ছিল, যা প্রকাশ্যে এলে তিনি বিপাকে পড়বেন। এ কারণেই তিনি তাঁকে হত্যা করে ফোনটি নিয়ে যান।’
তানিয়ার ভাড়া বাসার আশপাশের বিভিন্ন ক্লোজড সার্কিট টিভি (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া গেছে। এসব ফুটেজে দেখা যায়, ১৯ জানুয়ারি বিকেল ৫টা ৪২ মিনিটে তানিয়া বাসার গলিতে ঢোকেন। দুই হাতে কাপড়ের দুটি থলে এবং কাঁধে ঝোলানো ছিল ভ্যানিটি ব্যাগ। পেছনে কিছুটা দূরত্ব রেখে হাঁটছিলেন কুদ্দুসুর রহমান। তাঁর পরনে ছিল জ্যাকেট, কাঁধে ব্যাগ (ব্যাকপ্যাক) ও মুখে মাস্ক।
এর কিছুক্ষণ পরের আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়, ওই বাসা থেকে হুডি পরে বের হচ্ছেন কুদ্দুসুর রহমান, পিঠে ব্যাগ। তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করছেন।
■ বিকেলে রিকশায় ঘোরেন তানিয়া ও কুদ্দুসুর।
■ সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন। কিছুক্ষণ পর হুডি পরে দ্রুত বেরিয়ে যান কুদ্দুসুর।
■ দুই দিন পর তানিয়ার লাশ উদ্ধার।
এর আগে অন্য ফুটেজগুলোতে দেখা যায়, ঘটনার দিন বিকেলে কুদ্দুসুর ও তানিয়া ধানমন্ডির বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করেন। তখন কুদ্দুসুর মাস্ক পরে ছিলেন না। ধানমন্ডি থেকে দুজন রিকশা নিয়ে হাজারীবাগে ঢোকেন। বাসার কাছাকাছি দূরত্বে এসে তাঁরা রিকশা থেকে নেমে যান। এরপর তানিয়ার পেছন পেছন দূরত্ব বজায় রেখে কুদ্দুসুর হাঁটতে থাকেন।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তানিয়ার স্বামী কুমিল্লায় থাকেন। দুজনের বোঝাপড়ায় ঘাটতি থাকায় তানিয়া বেশির ভাগ সময় ঢাকায় নিজ পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। এর মধ্যে তানিয়ার সঙ্গে কুদ্দুসুর রহমানের সখ্য হয়। তাঁরা নিয়মিত মুঠোফোনে যোগাযোগ করতেন। একটা পর্যায়ে তানিয়া চেয়েছিলেন তাঁদের বিয়ে হোক। তাঁদের এই সম্পর্কের বিষয়টা তানিয়া তাঁর দু–একজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকেও জানিয়েছেন। এমন কিছু সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে তানিয়া হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের সূত্র পায় পুলিশ। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে তানিয়াকে হত্যার পর তাঁর মুঠোফোন, জুতা, ভ্যানিটি ব্যাগ, বাসার চাবিসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত কুদ্দুসুর রহমান ব্যাগে ভরে নিয়ে যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, কুদ্দুসুর রহমানকে গ্রেপ্তারে সহযোগিতা চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, তানিয়া হত্যার সঙ্গে মো. কুদ্দুসুর রহমান জড়িত। মামলার তদন্তকালে সাক্ষ্য-প্রমাণ, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, মুঠোফোনের কলতালিকা, আর্থিক লেনদেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া তথ্যপ্রমাণ ও তানিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যালোচনা এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় আসামি কুদ্দুসুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা আবশ্যক। ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সাধারণত বড় কোনো অপরাধে কোনো সেনা কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পেলে আমরা সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে বিষয়টি অবহিত করি। এই খুনের ঘটনায়ও আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি।’ তবে এখন পর্যন্ত কুদ্দুসুরকে হেফাজতে পায়নি পুলিশ।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কুদ্দুসুর রহমানের মুঠোফোন নম্বরে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে গত সোমবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। গতকাল বুধবার পর্যন্ত আইএসপিআর কিছু জানায়নি। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশি কিছু বলতে চান না। পুলিশের ধানমন্ডি জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. ইহসানুল ফিরদাউস বলেন, ‘তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আছে। আমরা তদন্তে সন্তুষ্ট। এর আগে সন্দেহভাজন হিসেবে ফ্ল্যাটের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে যেহেতু আর কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, এ জন্য এর বেশি বলা যাচ্ছে না।’
গত রোববার হাজারীবাগের ওই বাড়িতে গিয়ে তানিয়ার খুন হওয়া ফ্ল্যাটটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে কথা হয় ফ্ল্যাটের মালিক মোস্তাকিম আহমেদের (শাহিন) স্ত্রী মাছুমা পারভীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘটনার সময় ওই বাসায় দারোয়ান ও সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানকে নিয়ে কষ্টে দিন পার করছেন জানিয়ে মাছুমা বলেন, ‘আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, এক অফিসার এই কাজ করেছে। এরপরও আমার স্বামী কারাগারে। বাসা ভাড়া দিতে না পারায় আমরা খুব কষ্টে দিন পার করছি।’
prothomasha.com
Copy Right 2023