শামীম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রায় সময়ই সেখানে নানা মিটিং হয়। তেমনই এক মিটিং ছিল সেদিন। আর তা নিয়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই গলদঘর্ম শামীম। কোন এজেন্ডা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন, আর কোনটি এখনই প্রয়োজনীয় নেই—সেই তালিকা করতে করতে অফিসে ঢুকতে দেরিও হয়ে গেল তাঁর। তারপরও মিটিং নিয়ে নার্ভাসনেস গেল না একেবারেই!
এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই পড়েন। শুধু অফিস নয়, ব্যক্তি জীবনের নানা ক্ষেত্রেই আমাদের অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিতে হয় প্রতিনিয়ত। কিন্তু এর মধ্যে কতগুলো নিখুঁত হয়, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, একজন মানুষ দিনে হাজার হাজার সিদ্ধান্ত নেয়!
কী, অবাক হচ্ছেন তো। আসুন, হিসাবে ঢোকা যাক। আপনি সকালে ঘুম থেকে ওঠা ইস্তক আবার রাতে ঘুমানো পর্যন্ত অসংখ্য সিদ্ধান্ত নেন, যার অনেকগুলোর হিসাবই রাখেন না সচেতনভাবে। এর মধ্যে যেমন সকালের নাস্তা কী খাবেন, সেই সিদ্ধান্ত আছে, তেমনি আছে অফিস বা ব্যবসায়িক মিটিংয়ে কী নিয়ে আলোচনা করবেন, সেই সিদ্ধান্তও। গবেষণা বলছে, প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সব মিলিয়ে গড়ে ৩৩ হাজার থেকে ৩৫ হাজার সিদ্ধান্ত নেন। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই নেওয়া হয় অবচেতনভাবে, সাধারণভাবে ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ বিবেচনা করে। তবে কিছু কিছু সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই আলাদাভাবে সময় ও চিন্তা বরাদ্দের প্রয়োজন পড়ে। আর এত এত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভিড়ে আমরা সেই প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিই ভুলে যাই। ফলে নেওয়া সিদ্ধান্তে খুঁত থেকে যায় এবং ফলতঃ ভুগতে হয় আমাদেরকেই।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাধারণ প্রক্রিয়াটি কেমন?
প্রতিদিন আমাদের অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিতে হয়। গবেষকেরা বলছেন, বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই মানুষের মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেয়। মানুষের জ্ঞান আহরণের বা চিন্তা–ভাবনার যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অথবা কগনিশন, সেটিই অবচেতনভাবে এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। একজন মানুষের বেড়ে ওঠার পথেই তার পছন্দ–অপছন্দ এবং কিছু স্বতঃসিদ্ধ ভাবনা মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে। ওই অনুযায়ীই এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দৈনিক মোট সিদ্ধান্তের প্রায় ৯৫ শতাংশই মানুষ এভাবে নিয়ে থাকে। অনেকসময় একসাথে বেশ কয়েকটি করে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। কারণ তা না হলে, যদি এই ৩০ বা ৩৫ হাজার সিদ্ধান্ত একটি একটি করে কোনো ব্যক্তি নিতে যায়, তবে মস্তিষ্কে ‘শর্ট সার্কিট’ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, প্রচলিত ভাষায় বলতে গেলে একজনের মাথার তার ছিঁড়ে যেতে পারে! এই প্রক্রিয়াকে অনেকটা মস্তিষ্কের ‘অটোপাইলট মোড’ বললেও ভুল হবে না।কিন্তু বাকি ৫ শতাংশ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গভীর ভাবনার প্রয়োজন হয়। আর এই ৫ শতাংশ সিদ্ধান্তও যদি আপনি সাধারণভাবে নিতে থাকেন, তবে দেখবেন একের পর এক খুঁতযুক্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সেটি কীভাবে এড়ানো যায়, এবার আসুন তা–ই জানা যাক।
নিখুঁত সিদ্ধান্ত নিতে যা করা যায়
নিখুঁত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে সেটি নিয়ে ভাবনা–চিন্তা করা। যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে চিন্তা করে ছক সাজানো। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এগুলো নিজেদের ভাবনায় সাজাই। ফলে মন ও মাথা—দুইয়ের ওপরই চাপ পড়ে বেশ।
এসব নিয়ে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কাগজে লেখা। আপনি চাইলে ডায়েরিতেও লিখতে পারেন। আবার স্টিকি নোট বা যেকোনো টুকরো কাগজও ব্যবহার করতে পারেন। তবে সেই বিষয়টি নিয়ে আপনার মাথায় ঘুরতে থাকা ভাবনাকে লেখায় নিয়ে আসতেই হবে। এতে যা হবে, সেটি হলো—একটি বিষয়ের অনেকগুলো দিক নিয়ে ভাবার ক্ষেত্রে আপনার মস্তিষ্কের ওপর যে চাপটি পড়ছে, সেই কাগজে উঠে আসবে। মাথার ওপর চাপও কমবে। এবং আপনি তখন কাগজে লেখা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ভাবতে পারবেন সহজেই।অর্থাৎ, যে বিষয়ে নিখুঁত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, তার জন্য কাগজ ও সময়—দুটিই বরাদ্দ করতে হবে। কাগজে লিখতে হবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন—আজ আমি কেমন ঘরানার ব্যক্তি হব? আমি যাচ্ছি কোথায়? এবং কেন যাচ্ছি?
এই কাজটি যে কেউ নিয়মিতভাবে করতে পারেন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চা বা কফি খেতে খেতে পুরো দিনের একটি ছক এঁকে ফেলতে পারেন। এতে করে আপনার কাছে পুরো দিনের একটি নির্ধারিত রুটিন থাকবে। এতে ভুলে যাওয়ার রোগের যেমন নিদান হবে, ঠিক একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে লিখিতভাবে বিস্তারিত বোঝার সুবিধা হবে। দেখবেন, আপনার চোখের সামনে তখন একটি জটিল বিষয়ও জলবৎ তরলং হয়ে গেছে। হ্যাঁ, এভাবেই যে সব সময় শতভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তার গ্যারান্টি আসলে দেওয়া যায় না। কারণ, একেক মানুষ একেকভাবে ভাবেন। কিন্তু অন্তত একেবারে ফালতু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি কমে আসবে বেশ
এই প্রক্রিয়ায় লাভ কতটা?
ওপরের বর্ণিত প্রক্রিয়ায় লাভ অনেক। উদাহরণ হিসেবে নিচে কিছু সুবিধার কথা উল্লেখ করা হলো:১. আপনি লেখালেখি করে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলে, সেটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। মানুষের মস্তিষ্কের দুটি অংশ—ডান ও বাম। লেখার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি এই দুটো অংশকেই কাজে লাগাতে পারেন। এতে করে মস্তিষ্কের যুক্তিপূর্ণ অংশটি যেমন কাজ করে, তেমনি কাজ করে সৃজনশীল অংশটিও। ফলে আপনার আবেগীয় অনুভূতি আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পুরো প্রক্রিয়াটিকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায় না। এ কারণে এই প্রক্রিয়ায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ হয়।
২. জটিল সিদ্ধান্ত নেওয়াও সহজ হয়ে আসে এ প্রক্রিয়ায়। আমাদের সক্রিয় স্মৃতি দিয়ে একসঙ্গে তিন থেকে চারটি বিষয় নিয়ে কাজ করা যায়। আমাদের দুই হাতও এভাবেই কাজ করে থাকে। কিন্তু কখনো কখনো একটি সিদ্ধান্ত নিতেও অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন: আপনি কর্মস্থল পরিবর্তন করবেন কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই গভীর চিন্তা–ভাবনার প্রয়োজন। এটি কোনো সাধারণ সিদ্ধান্ত নয়, বরং জটিল সিদ্ধান্ত। তাই এ ব্যাপারে বসে কাগজে লিখে সিদ্ধান্ত নেওয়াই ভালো। লেখার ক্ষেত্রে আপনি আলাদা করতে পারবেন যে—কেন চাকরি পরিবর্তন করা জরুরি? এর পেছনে কারণ কী কী? আপনার দ্বিধা থাকলে সেটি কোন কোন ক্ষেত্রে আছে? সেগুলো কি এড়ানো যায় আদৌ? ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে একটি জটিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টিকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা যায় এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের সমাধান বের করার মাধ্যমে সামগ্রিক সমাধানও করা যায় সহজে।
৩. এই প্রক্রিয়ায় নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায় সহজে। কারণ, আপনি তখন বিচার্য বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ পাচ্ছেন। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানে এ–সংক্রান্ত একটি গবেষণা হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, যখন আমরা কাগজে লিখে বিস্তারিত বুঝে একটি সিদ্ধান্ত নিই, তাতে একজন ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসের মাত্রা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি থাকে। আর আত্মবিশ্বাস যখন যৌক্তিক হয়, তখন স্বভাবতই সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ঢের।
যেভাবে শুরু করবেন
সাধারণত খুব কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হলে, অর্থাৎ একেবারে বাধ্য না হলে আমরা চিন্তন প্রক্রিয়ায় খুব বেশি পরিবর্তন আনতে চাই না। সে ক্ষেত্রে তেমন পরিস্থিতিতে পড়লেও আপনি উপরিউক্ত পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। তবে সবচেয়ে ভালো হয়, একে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে। সেক্ষেত্রে কীভাবে শুরু করবেন, সেটি যদি বুঝতে না পারেন, তবে কিছু প্রশ্ন আপনাকে সহযোগিতা করতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চিন্তন প্রক্রিয়া শুরুর সময় কিছু প্রশ্ন নিজের সামনে রাখুন। এগুলো হলো:
১. সিদ্ধান্তটি নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি কোন ধরনের আবেগ অনুভব করছেন?
২. সিদ্ধান্তটি নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয় কি আপনার মনযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে?
৩. সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বিষয়ে আপনি কি ভেবেছেন?
৪. সিদ্ধান্তটি নেওয়ার জন্য আর কোন ধরনের তথ্য আপনার জানা প্রয়োজন?
৫. সিদ্ধান্তটি নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস অর্জনে কী বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন? হলে তা কী ধরনের?
৬. সব দিক নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করে, নিজের সর্বোত্তম সামর্থ্য দিয়ে কি আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন বা পেরেছেন?এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একে একে সাজালে আশা করা যায় যে, কোনো বিষয়ে নিখুঁত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে যে কেউ বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতে পারবে। সব সময়ই যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনেই লেখালিখির প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে—তা কিন্তু নয়। বরং এটি প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে আপনার নিত্যকার জীবন আরও সুশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে। দুশ্চিন্তা তখন শরীরে বাসা বাঁধার বদলে নতুন স্থানে (কাগজে বা ডায়েরিতে) যাওয়ার সুযোগ পাবে। এতে লাভ কিন্তু দিনশেষে আপনারই!
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একে একে সাজালে আশা করা যায় যে, কোনো বিষয়ে নিখুঁত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে যে কেউ বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতে পারবে। সব সময়ই যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনেই লেখালিখির প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে—তা কিন্তু নয়। বরং এটি প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে আপনার নিত্যকার জীবন আরও সুশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে। দুশ্চিন্তা তখন শরীরে বাসা বাঁধার বদলে নতুন স্থানে (কাগজে বা ডায়েরিতে) যাওয়ার সুযোগ পাবে। এতে লাভ কিন্তু দিনশেষে আপনারই!
prothomasha.com
Copy Right 2023