শীতের তীব্রতা কমে আসায় রাজধানীতে বাড়ছে কিউলেক্স মশার উপদ্রুব যা নগরবাসীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কিউলেক্স মশা নিধনে তেমন কোনো ভ‚মিকাও চোখে পড়ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধরন পাল্টে দেশে স্থায়ী হয়ে গেছে এডিস মশা। কিউলেক্স মশার প্রজননও বাড়ছে। এদিকে গত বছর এডিস মশার ভয়াবহ দাপট দেখেছে দেশবাসী। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে গত বছর রেকর্ডসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেইসঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে অতীতের যে কোনো সময়কে। এখনো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন মানুষ। এর মধ্যে আবার কিউলেক্সের চোখরাঙানিতে তটস্থ রাজধানীবাসী।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে ডোবা-নালা, ড্রেন-ঝিল বা খালে কমে যাওয়া নোংরা পানিতে কিউলেক্স জন্মাচ্ছে। মার্চ মাসে এই মশার উপদ্রব সবচেয়ে বেশি হয়। তারা বলছেন, কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি এবং ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশে ফাইলেরিয়া রোগ ছডায়। এই রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। একে স্থানীয়ভাবে ‘গোদ’ রোগও বলা হয়। এছাড়া এ মশার কামড়ে জাপানি এনকেফালাইটিস হয়। এ জন্য সিটি করপোরেশনকে আগে থেকেই মশা নিধনে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
অন্যদিকে নাগরিকদের অভিযোগ, নাগরিক সেবায় সিটি করপোরেশনের যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে তার মধ্যে মশা নিধন অন্যতম। কিন্তু এ কাজটিই ঠিকভাবে করতে পারছে না ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ফলে বছরজুড়ে এডিস ও কিউলেক্স মশার বিস্তার ঘটছে। আর হাসপাতালে বাড়ছে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। আইসিডিআর,বি’র বরাত দিয়ে বার্তাসংস্থা বিবিসি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায়, কিউলেক্স মশাবাহিত ‘জাপানিজ এনকেফালাইটিস’ রোগে আক্রান্ত রোগী মিলেছে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৬টিতে। বর্তমানে খুব আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে না গেলেও মানবদেহে এ রোগটির প্রভাব মারাত্মক। আর তাই এখন থেকেই সচেতনতার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
আইসিডিআর,বি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজন রোগী মারা যান। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, রোগটিতে মৃত্যু হার ৩০%। যারা আক্রান্ত হয়েও বেঁচে থাকেন তাদের মধ্যে ৩০-৫০ শতাংশ রোগীর শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা তৈরি হয়। আক্রান্তদের স্থায়ী বুদ্ধিবৃত্তিক, আচরণগত ও স্নায়বিক ক্ষতি হয়, অনেকে পঙ্গু হয়ে যান, বার বার খিঁচুনি হয়, রোগী আর কথা বলতে পারেন না। সব বয়সের মানুষের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও ১৫ বছর বা এর চেয়ে কম বয়সি শিশুদের মধ্যে ‘জাপানিজ এনকেফালাইটিস’ আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। নাগরিকদের অভিযোগ থাকলেও মশা নিধনে নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করছেন না দুই সিটির কর্তাব্যক্তিরা। তাদের দাবি, মশা নিধনে বছরজুড়েই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। তারপরও মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। আগে শুধু বর্ষা মৌসুমে এডিস মশা জন্মাতো। এখন দেখা যায়, সারা বছরই মানুষের ডেঙ্গু হচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমের এডিস মশা বর্ষায় জন্মাচ্ছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।
২০২৩ সালের পুরোটা জুড়েই দেশবাসীকে ভুগিয়েছে ডেঙ্গু। সরকারি হিসাবে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। তবে গত বছর মে মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে। তবে গত বছরের ডিসেম্বর মাসেও ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ অব্যাহত ছিল। নতুন বছরে এসে মৃত্যু কমলেও ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন রোগী।
দুই সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, মশা নিয়ন্ত্রণে সারা বছরই নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এরই অংশ হিসেবে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও জরিমানা করা হয়। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে নগরীতে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং এ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কিনতে ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছিল ৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ টাকা দিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। জনসচেতনতা তৈরিতে ডিএনসিসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) ও জাতীয় স্কাউট দল। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম ও জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছে। এছাড়া যেসব ভবনে এডিসের লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে তাদের জরিমানা করছে ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া মসজিদের ইমাম, স্কুল-মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়েও জনসচেতনতামূলক কর্মকাÐ পরিচালনা করছে সংস্থাটি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতেও মশক নিধনে অনুরূপ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ। এছাড়া গত বছরের ২৩ জুলাই মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে গবেষণার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে ডিএনসিসি। এ সমঝোতার আওতায় ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কীটনাশকের কার্যকারিতা এবং মশার ঘনত্ব ও প্রজাতি বিশ্ববিদ্যালয়টির ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে। আর পরীক্ষার মাধ্যমেই মশা নিধনে কীটনাশক প্রয়োগ ও যে কোনো ডিভাইসের ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ে জনসচেতনতামূলক অধ্যায় যুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছে ডিএনসিসি। স্কুল-কলেজে মশা নিধনে সচেতনতায় বইও বিতরণ করেছে সংস্থাটি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, এডিস ও কিউলেক্স মশার চরিত্র বদলে গেছে। ফলে ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশে স্থায়ী। অর্থাৎ সারা বছরই এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হবে। এটি আর শূন্যতে নামানো যাবে না। বিভিন্ন ডোবা-নালা, ড্রেন-ঝিল বা খালে পানি কমে যাচ্ছে। সেখানে নোংরা পানিতে কিউলেক্স জন্মাচ্ছে। ফলে এখন থেকে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত কিউলেক্স মশা বাড়তে থাকবে। মার্চে কিউলেক্সের উপদ্রব সবচেয়ে বেশি বাড়বে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু মশা নিয়ন্ত্রণ করে মশাবাহিত রোগ শতভাগ নির্মূল সম্ভব নয়। এজন্য উপায় হলো টিকা। বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরেই টিকা আনার কথা বলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারের উচিত দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালে জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগের টিকার অনুমতি দিয়েছে। ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশ তাদের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে জাপানিজ এনকেফালাইটিসের টিকা প্রবর্তন করে রোগটির প্রকোপ অনেকটাই কমিয়ে এনেছে। বাংলাদেশ এখনো জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে এই ভ্যাকসিন চালু করেনি। তবে সরকার জাপানিজ এনকেফালাইটিসের টিকা দেওয়ার লক্ষ্যে বেশ কিছু পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণের কথা বলেছে। এই টিকার সফল বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ থেকে থেকে জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগটি নির্মূল করা সম্ভব হবে, বলছেন তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে চার ধরনের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে চীনে উৎপাদিত লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড SA14-14-2 সর্বাধিক ব্যবহৃত টিকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন কোনো টিকা আনতে গেলে টিকা-বিষয়ক জোট- গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনের (গাভি) কাছে আবেদন জানাতে হয়। এরপর সেরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে এই টিকাগুলো দেশে আসে। টিকার জন্য ‘গাভিতে’ আবেদন প্রক্রিয়াধীন আছে জানিয়ে আইসিডিডিআর,বি’র প্রধান গবেষক রেবেকা সুলতানা সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমকে জানান, টিকা পাওয়া গেলে এটি রাজশাহীর ২টি জেলা ও রংপুরের ২টি জেলায় দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে এই তালিকায় চট্টগ্রামকেও যুক্ত করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সরকার কিউলেক্সের টিকাটি হাতে পেলে একে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এছাড়া যেসব অঞ্চলে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি সেখানে ১৫ বছর বা তার কম বয়সিদের এই টিকা দেওয়ার ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগে প্রচার-প্রচারণা চালানোর উদ্যোগও রয়েছে।
prothomasha.com
Copy Right 2023