সরকারি চাকরিতে নাম লিখিয়েই হাঁটেন অনিয়মের বাঁকে বাঁকে। চাকরির বয়স মাত্র ছয় বছর পার হলেও এরই মধ্যে খেয়েছেন সাত ঘাটের জল। নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে অন্তত চারবার বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন বাবুল সরকার। তিনি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গাজীপুর কার্যালয়ের সদ্য সাবেক সহকারী পরিচালক (এডি)। সাধারণত কাজে যোগ দেওয়ার দুই বছর পর সরকারি চাকরি স্থায়ী হয়। তবে ধারাবাহিক অপকীর্তির কারণে বাবুল সরকারের বেলায় এ নিয়ম খাটেনি। শাস্তি হিসেবে এখনও তাঁর চাকরি অস্থায়ীর বৃত্তে বন্দি।
অবিরাম দুর্নীতি, বিপরীতে একের পর এক শাস্তি! তবু যেন দমছেন না বাবুল সরকার। ডিএনসির গাজীপুরের এডি থাকার সময় ঘুষের লেনাদেনার আদ্যোপান্ত সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে নতুন করে আলোচনার খাতা খুলেছেন তিনি। গত বুধবার তাঁকে গাজীপুর থেকে ডিএনসির পিরোজপুর জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়।
অনুমোদনহীন রাসায়নিক ব্যবহার করার জন্য আপনাদের বিরুদ্ধে যদি মামলা হয়, তাহলে ১০ বছরের সাজা হবে। কিন্তু আপনারা সমঝোতা করলে কোনো মামলা হবে না।’– এমন সবক দিয়ে গাজীপুর কাশিমপুরের নয়াপাড়ার মাল্টিফ্যাবস লিমিটেডের কর্তাদের কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন এডি বাবুল। পরে ঘুষের রফা হয় ১০ হাজার টাকায়। ১ হাজার টাকার ১০টি নোট সাদা খামে ঢুকিয়ে বাবুল সরকারকে দিলে তিনি প্যান্টের ডান পকেটে রাখেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার ওই ঘটনা ধরা পড়ে মাল্টিফ্যাবসের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। পরে অবশ্য রাসায়নিক ব্যবহারের নিবন্ধনের জন্য ওই কারখানার কর্মকর্তাদের কাছে আরও ১৬ লাখ টাকা দাবি করেন বাবুল। এ ঘটনায় এরই মধ্যে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।
বাবুল শুধু মাল্টিফ্যাবসের কাছেই নয়, এমন অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেই ঘুষ হাতিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে একাধিক বিভাগীয় মামলাও হয়েছে। কোনোটিতে হয়েছে লঘু বিচার, কোনোটিতে পেয়েছেন নিস্তার। তবু ফেরেনি হুঁশ, মানুষকে ফাঁদে ফেলে তুলছেন ঘুষ।
জানা যায়, বাবুল সরকার ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর ডিএনসিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। চাকরির বছর দেড়েকের মাথায় দুর্নীতির অভিযোগে প্রথম বিভাগীয় মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। তখন তিনি ডিএনসির বান্দরবান কার্যালয়ের এডি ছিলেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০২১ সালে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁর বেতন গ্রেড নিম্নতর ধাপে অবনমন করা হয়। এ ছাড়া একই বছর আরেক দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে শাস্তি হিসেবে তিন বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) স্থগিত করা হয়। গত ২৫ এপ্রিল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে গাজীপুরে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে মাদকদ্রব্য জাতীয় ওষুধের বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর চিঠি ইস্যু করেন বাবুল। এ ধরনের দাপ্তরিক কাজের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে চিঠি ইস্যু করা নিয়মে নেই। এ ব্যাপারে গত ১০ মে তাঁকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ২০২২ সালে আরেকটি বিভাগীয় মামলা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ঘুষ নেওয়ার নয়া কায়দা
বাবুল সরকারের ঘুষ নেওয়ার কায়দাটা একটু আলাদা। আগে যার কাছ থেকে ঘুষ নেন, পরের প্রতিষ্ঠানের কাছে ঘুষ নেওয়ার ক্ষেত্রে ওই আগের ব্যক্তির কাছে ঘুষের ‘রেট’ জেনে নিতে বলেন তিনি। আগের ব্যক্তি যে অঙ্কের টাকা দিয়েছেন, পরের জনের কাছে একই হারে ঘুষ নেন।
বাবুল মাল্টিফ্যাবস থেকে তাৎক্ষণিক ১০ হাজার টাকা নিয়েই ছেড়ে দেননি। পরে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক আবু সেহাবকে ডিএনসির গাজীপুর কার্যালয়ে দেখা করতে বলেন। সেহাবকে বলা হয়, কারখানায় ‘প্রিকারসর কেমিক্যাল এসিটন’ ব্যবহার করতে হলে নিবন্ধন নিতে হবে। ১৩ ফেব্রুয়ারি আবু সেহাব যান বাবুল সরকারের কার্যালয়ে। নিবন্ধনের জন্য কীভাবে আবেদন করতে হবে, তার একটি নমুনা কপি বাবুল তাঁকে দেন। এর পর প্রতিষ্ঠানের আরেক কর্মকর্তা খ. আহমাদুল করিম ২৪ ফেব্রুয়ারি কারখানায় ‘প্রিকারসর কেমিক্যাল এসিটন’ ব্যবহারের অনুমোদন চেয়ে আবেদনপত্র জমা দেন বাবুলের কাছে। তখন বাবুল আহমাদুলকে আরেকটি কারখানার কর্মকর্তার ফোন নম্বর দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের জন্য কত টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে, তা জেনে নিতে বলেন। তাঁর কথামতো আহমাদুল ফোন করে জানতে পারেন, নিবন্ধন করতে লাগবে ১৬ লাখ টাকা ঘুষ। পরে ফোনে কথা বলা শেষ করে বাবুলের কাছে আহমাদুল জানতে চান, নিবন্ধনের জন্য তাদের কত টাকা দিতে হবে। বাবুল তাঁকে বলেন, ‘ফোনে শুনলেন না, কত টাকা লাগবে? যা শুনেছেন তাই-ই লাগবে।’
ডিএনসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, আদতে ওই নিবন্ধনের জন্য সরকারি মাশুল ২ হাজার টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে ভ্যাট-ট্যাক্স। প্রিকারসর কেমিক্যাল ব্যবহারের নিবন্ধন নিতে প্রতিষ্ঠান আবেদন করার পর সংশ্লিষ্ট জেলা কার্যালয় তদন্ত করে বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠায়। পরে প্রধান কার্যালয় অনুমোদন দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়। এর পর জেলা কার্যালয় নিবন্ধন ইস্যু করে।
বাবুলের কাছ থেকে নিবন্ধন নিতে ১৬ লাখ টাকা লাগবে– এ কথা শুনে ঘুরে দাঁড়ায় মাল্টিফ্যাবস। এর পর নিবন্ধনের টাকা কমানোর জন্য ৪ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক আবু সেহাব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে লিখিত আবেদন করেন। তাতে ১০ ফেব্রুয়ারি বাবুল সরকারের ঘুষ নেওয়ার তথ্যও তুলে ধরা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাবুল সরকার ও তাঁর চালক আইয়ুব আলী মাল্টিফ্যাবসে গিয়েছিলেন। এ সময় বাবুল সরকার ইউনিফর্ম পরা ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির ৯ তলার ছাদবাগানে এ ঘুষের টাকা নেন তিনি।
জানা যায়, গত জানুয়ারিতে গাজীপুরের শফিপুরের করোনি গার্মেন্ট থেকে প্রিকারসর কেমিক্যাল ব্যবহারের নিবন্ধনের জন্য ১৬ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন বাবুল সরকার। তবে প্রথম পর্যায় প্রতিষ্ঠানটি ৭ লাখ টাকা দেয় বাবুলকে। ওই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গেই ঘুষের টাকার পরিমাণ জানতেই ফোনে কথা বলেছিলেন আহমাদুল। করোনি গার্মেন্টের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নিবন্ধন নিতে সরকারি ফি কত জানতে চেয়েছিলাম এডি বাবুলের কাছে। তিনি বলেছিলেন, ১৬ লাখ টাকা দিলে সব কাগজপত্র তিনি নিজেই করে দেবেন। দাবি করা টাকা না দিলে নিবন্ধন দেবেন না বলেও হুমকি দিয়েছিলেন বাবুল।
অভিযোগ পাওয়ার পর ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) কাজী আল আমিন তদন্ত শুরু করেন। তিনি বলেন, তদন্ত চলছে। কর্তৃপক্ষের কাছে যথাসময়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কী বলছেন বাবুল
এসব বিষয়ে বাবুল সরকার বলেন, মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড অনুমোদন ছাড়াই দীর্ঘদিন প্রিকারসর রাসায়নিক ব্যবহার করে আসছে। বারবার বলার পরও তারা নিবন্ধন নেয়নি। নিবন্ধন নিতে বলার জন্য সেদিন ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তবে আমার বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা অভিযোগ করছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজের বিষয়ে তিনি বলেন, টাকা নেওয়া হচ্ছে– এটা কী দেখতে পারছেন? নিবন্ধন নিতে কী কী কাগজ জমা দিতে হবে তা তাদের ফটোকপি করতে দিয়েছিলাম। ফটোকপি করে সেসব কাগজপত্র ফেরত দেয় ওই খামে।
prothomasha.com
Copy Right 2023