দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায় পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। আট বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার সরিয়ে নিয়েছিল হ্যাকাররা। ওই ঘটনায় করা মামলার তদন্ত এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। যদিও সিআইডি বলছে, তাদের তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তাব্যবস্থা সংরক্ষণে অবহেলা ও গাফিলতির কারণে হ্যাকাররা দেশের রিজার্ভের টাকা সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরসহ ১২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায় পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি।
বাকি কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন একজন নির্বাহী পরিচালক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), একজন মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে ডেপুটি গভর্নর), চারজন যুগ্ম পরিচালক (তাঁদের দুজন বর্তমানে উপমহাব্যবস্থাপক, একজন যুগ্ম পরিচালক ও একজন অবসরে), তিনজন উপমহাব্যবস্থাপক (দুজন বর্তমানে জিএম) ও দুজন উপপরিচালক। তৎকালীন গভর্নর ও নির্বাহী পরিচালকের বাইরে বাকি কর্মকর্তারা তখন ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং, আইটি অপারেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ, পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ এবং ব্যাক অফিস অব দ্য ডিলিংস রুমের কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁদের কেউ সার্ভার কক্ষ খোলা রেখে, কেউ ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে, কেউবা অনুপস্থিত থেকে প্রকারান্তরে হ্যাকারদের সুযোগ করে দিয়েছেন।
তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানের দায় সম্পর্কে তদন্তে যে বিষয়টি উঠে এসেছে, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) সার্ভার একটি সংবেদনশীল ব্যবস্থা। তা সত্ত্বেও গভর্নর সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএসের (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) সংযোগ করার অনুমোদন দেন এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন। এটাকে অপরাধমূলক উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তদন্তকারীরা। আরটিজিএস একটি বিশেষায়িত তহবিল স্থানান্তর ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তাৎক্ষণিক তহবিল স্থানান্তর করা যায়।তদন্তে আরও এসেছে, তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর-৪ আবুল কাশেম সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএস সার্ভিস প্রদানের বিপক্ষে ছিলেন। যার কারণে আরটিজিএসের সার্ভিস দেওয়া–সংক্রান্ত ফাইল গভর্নর আতিউর রহমান নিজে সই করে অনুমোদন দেন। এ ছাড়া অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি দ্বারা সুইফট সার্ভারের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা, রিজার্ভ চুরি হওয়ার পর বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে ক্রাইম সিনে (অপরাধ সংঘটনের স্থানে) এনে অপরাধস্থলের তথ্যপ্রমাণাদি পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা, রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ৪০ দিন পর্যন্ত গোপন রাখার বিষয়টিকেও অপরাধমূলক উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিআইডি।
এ বিষয়ে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের বক্তব্য জানতে গতকাল অনেকবার চেষ্টা করা হয়। তাঁর মুঠোফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। অবশ্য আতিউর রহমানের সম্পর্কে এসব তথ্য সিআইডির তদন্তে অনেক আগেই এসেছিল। এ নিয়ে ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আতিউর রহমানের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘একজন গভর্নর একা সিদ্ধান্ত নেয় না, সিস্টেম সেখানে কাজ করে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ভিকটিম ছিল। ঘটনাটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে। সরকার এটার জন্য মামলা করেছে।’
সুইফট সার্ভারের সঙ্গে আরটিজিএস সংযোগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহার যোগসাজশ সিআইডির তদন্তে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আরটিজিএস সংযোগের কারণে সুইফট সার্ভারের নিরাপত্তাব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। পরে এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয় বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত শুভঙ্কর সাহারও ফোন বন্ধ থাকায় এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সিআইডির তদন্তে যেসব কর্মকর্তার দায় চিহ্নিত হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ব্যবস্থা নিয়েছে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শনিবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, পুলিশি প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে সিআইডি সূত্র বলছে, তদন্তে যে ১২ কর্মকর্তার নাম এসেছে, তাঁদের মধ্যে এই মেজবাউল হকও রয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে তদন্তে এসেছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর দেশের কোনো তদন্ত সংস্থাকে না জানিয়ে তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক মেজবাউল হক ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিদেশি দুটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। তাদের দিয়ে ক্রাইম সিন থেকে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহের নির্দেশ দেন, যা পুরোপুরি বেআইনি কাজ। এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আলামত নষ্ট হয়ে যায়।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেজবাউল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আট বছর আগে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। দুর্বৃত্তরা সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা সরিয়ে নেয়। এই অর্থ ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের শাখায় চারটি অ্যাকাউন্টে যায় এবং সেখান থেকে দ্রুত টাকা উত্তোলন করা হয়।
পরে বিভিন্ন সময় ফেরত আসে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এখনো রয়ে গেছে ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৫৬১ কোটি টাকা। ঘটনার ৩৯ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি, মানি লন্ডারিং ও সাইবার অপরাধ দমন আইনের ধারায় মামলা করা হয়। পরে ওই মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের মধ্যে লেনদেন করতে সুইফট ব্যবহার করে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সুইফট বার্তার মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আটজন। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের (এবিডি) আওতাধীন একটি কক্ষে (ব্যাক অফিস) এই বার্তা বিনিময় হয়। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিজার্ভ চুরির এই ঘটনায় জড়িত হিসেবে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, শ্রীলঙ্কা ও হংকং—এই আট দেশের ৭৬ ব্যক্তির নাম এসেছে।
এ মামলার ফরেনসিক প্রতিবেদন ও হালনাগাদ অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে সিআইডি। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গাফিলতি ও অবহেলার অভিযোগ রয়েছে, সেখানে ফরেনসিক প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ ইয়াসিন বলেন, তিনি এ মামলার দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা। তার আগে তদন্তের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা এ বিষয়ে আদালতের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন। পরে আদালত অনুমতি দিলে ফরেনসিক ও হালনাগাদ অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে চলা মামলার স্বার্থে এই তথ্যগুলো দেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োজিত আইনি প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করার কথা।
আজ রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির আট বছর হতে যাচ্ছে। এখনো এ–সংক্রান্ত মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে দিতে পারেনি সিআইডি। কবে নাগাদ দেওয়া হবে, সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলছে না তদন্তকারী সংস্থাটি। মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার জন্য এ পর্যন্ত ৭৬ বার আদালত থেকে সময় নিয়েছে সিআইডি। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সর্বশেষ তারিখ ছিল গত ৩১ ডিসেম্বর। তদন্ত কর্মকর্তার সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন ২৫ ফেব্রুয়ারি।
মামলাটির তদন্ত তত্ত্বাবধান করছেন সিআইডির প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া। মামলার অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে গতকাল তিনি বলেন, তদন্ত শেষ পর্যায়ে। মালয়েশিয়া, মিসর, জাপান, ফিলিপাইন ও হংকংয়ের নাগরিকদের জড়িত থাকার তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে ইতিপূর্বে তাঁরা পেয়েছেন। তবে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও শ্রীলঙ্কার কাছে চাওয়া তথ্য এখনো আসেনি। এসব দেশে তাঁরা চিঠি পাঠিয়েছেন, সেখানকার দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা এক মাস সময় নিয়েছে। ওই সব তথ্য পাওয়া গেলেই দ্রুত আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া যাবে।
prothomasha.com
Copy Right 2023