ভোটের আগেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাহসীন বাহারই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের পরবর্তী মেয়র হচ্ছেন। ভোটের ফলাফলেও দেখা যায় প্রতিদ্বন্দ্বী তিন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে ৩ হাজার ৬৫৫ ভোট বেশি পেয়েছেন তিনি। তবে তাঁর প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিএনপির সাবেক দুই নেতা মনিরুল হক এবং নিজামউদ্দিনের ভোট কমেছে, নাকি রাস্তার মোড়ে মোড়ে প্রতিপক্ষের ‘পাহারার’ ব্যবস্থা তাঁদের ভোট কমিয়ে দিয়েছে—এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে নানা আলোচনা চলছে। দুই প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভোট কমেছে, নাকি বিএনপির দলীয় ভোট কমেছে—সে প্রশ্নও উঠেছে। যদিও বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি এবং কোনো প্রার্থীকে দলগতভাবে সমর্থনও জানায়নি।
এর আগে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনিরুল হক (সাক্কু) ও নিজামউদ্দিন (কায়সার) ৭৯ হাজার ৬৬ ভোট পান। এর মধ্যে মনিরুল হক ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট আর নিজাম ২৯ হাজার ৯৯ ভোট পান। এবার দুজনে মিলে ৪০ হাজার ৫২ ভোট পেয়েছেন, যা গতবারের চেয়ে ৩৯ হাজার ১৪ ভোট কম। হিসাবে প্রায় অর্ধেক ভোট কম পেয়েছেন দুজন। বিশেষ করে গত নির্বাচনে ৩৪৩ ভোটে হারা মনিরুল হক এবার ২১ হাজার ৯৯৩ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন।
ভোটের এমন ফলাফল নিয়ে কুমিল্লা মহানগর ও জেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ১২ জন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপির সমর্থকেরা এমনিতেই ভোটের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। বড় একটি অংশ ভোটকেন্দ্রেই যাননি। আবার অনেকে বলছেন, বিএনপি সমর্থক ভোটারদের বড় একটি অংশকে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি। তাঁরা যাতে কেন্দ্রে না যান, সে জন্য ভোটের আগে থেকে ভীতির পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন তাহসীন বাহারের কর্মী-সমর্থকেরা। আর ভোটের দিন পাড়া-মহল্লার অলিগলি, রাস্তার মোড়গুলো ছিল তাহসীনের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে, পাহারায়। এতে বিএনপির সমর্থক ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত হন। ভোটের দিন এসব অভিযোগ ওঠার পর তাহসীন বাহার বলেছিলেন, খুবই স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে। মোড়ে মোড়ে পাহারার বিষয়টা আসলে অভিযোগ ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ী হলেও এবার তাহসীন মেয়র হয়েছেন ৪৮ হাজার ৮৯০ ভোট পেয়ে। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক ৫০ হাজার ৩১০ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার দেড় বছরের মাথায় গত ডিসেম্বরে মারা যান আরফানুল। তাঁর মৃত্যুতে কুমিল্লায় শুধু মেয়র পদে গত শনিবার (৯ মার্চ) উপনির্বাচন হলো। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা নূর-উর রহমান মাহমুদ প্রার্থী হলেও ভোটে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। তিনি পেয়েছেন মাত্র ৫ হাজার ১৭৩ ভোট। নতুন মেয়র তাহসীন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বাবা কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন।
নির্বাচনে টেবিলঘড়ি প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মনিরুল হক। গতকাল বলেন, ‘মানুষ তো কেন্দ্রে যাইত পারে নাই। পরিবেশ নাই, যাইব ক্যামনে। আমরা তো মানুষের কাছে গেছি কেন্দ্রে আওনের লাইগা। কিন্তু (ভোটের) তিন দিন আগে থেইকা দিনে-রাতে যেভাবে বোম মারছে, ঘরে ঘরে গিয়া হুমকি দিছে, এমন নজির আমি দেখি নাই। এডি কারে কমু (বলব)।’ মনিরুল কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুমিল্লা সিটির সাবেক মেয়র। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ২০২২ সালে সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।
ভোট নিয়ে মনিরুলের মতোই একই ধরনের অভিযোগ করেছেন ঘোড়া প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করা নিজামউদ্দিন। গতকাল তিনি বলেন, ‘আমার ভোটাররা মূলত বিএনপির নেতা-কর্মী এবং তাঁদের পরিবার-স্বজন। কিন্তু সকাল থেকেই বিএনপি-অধ্যুষিত এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায় সরকারি দল। বিএনপির ভোটারদের ঘর থেকেই বের হতে দেয়নি। দেখা গেছে, একটি কেন্দ্রে বিএনপির যত সক্রিয় কর্মী আছেন, তার চেয়েও কম ভোট পেয়েছি ওই কেন্দ্রে।’
নিজাম কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গত সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় তাঁকেও বহিষ্কার করা হয়। গত শনিবার রাতে ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনায় এই নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের অনাগ্রহ এবং অনাস্থার বিষয়টিও উঠে আসছে। ভোটের হার ছিল ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। কাউন্সিলর পদে ভোট না হওয়ায় ভোটার উপস্থিতি অনেকটাই কম ছিল। অন্যদিকে বিএনপি-সমর্থকেরা যাতে ভোটকেন্দ্রে না যান, আওয়ামী লীগের বর্তমান ও সাবেক কাউন্সিলরদের অনেকে সেই চেষ্টা চালান বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা কাজটি করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের ‘সুনজরে’ থাকার আশায়।
ভোটে অনাগ্রহের কারণ হিসেবে যেসব বিষয় উঠে এসেছে তার অন্যতম হচ্ছে, সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন যে প্রক্রিয়ায় নিজের মেয়েকে মেয়র পদে প্রার্থী করান, তারপর নেপথ্যে এবং প্রকাশ্যে যেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তাহসীন মেয়র হচ্ছেন। এতে ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ কমে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভোটের দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্র ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠেকাতে তাহসীনের কর্মী-সমর্থকদের পাহারা। এতে বিএনপি-সমর্থক ভোটারদের বড় একটি অংশ কেন্দ্রে যায়নি। কুমিল্লা শহরের কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউর বাসিন্দা মানিক দাস বলেন, ‘আমার পরিবারে চারজন ভোটার। আমি ছাড়া কেউ ভোট দিইনি। কারণ, ভোটে মানুষের আস্থা নেই। এখন নির্বাচন মানুষকে আকৃষ্ট করে না।’
মেয়র প্রার্থী নিজামউদ্দিন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিন-উর রশিদের (ইয়াছিন) শ্যালক। তিনি গত সিটি নির্বাচনের মতো এবারও নিজামউদ্দিনের জন্য নেপথ্যে কাজ করেছেন বলে নেতা-কর্মীদের অনেকে বলছেন। আমিনের ছেলে ইফতেখার রশিদ ভোটের মাঠে নিজামের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। এ নিয়ে গত দুই নির্বাচনেই মনিরুল হকের পরাজয়ে নিজামের প্রার্থিতা বড় ভূমিকা রেখেছে। ভোটের হিসাবেও সেটি স্পষ্ট।
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির দায়িত্বশীল তিনজন নেতা বলছেন, এই নির্বাচনে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। একটি হচ্ছে মনিরুল হক এবার দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশকে পাশে পাননি, যাঁরা গতবার তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে নির্বাচনে দলীয় সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় মনিরুল হক ও নিজামউদ্দিনের প্রতি দলের নিবেদিত কর্মী-সমর্থকদের একটি অংশের সে রকম আবেগ দেখা যায়নি। ভোটে পরাজয় তাঁদের দলে ফেরাটা আরও কঠিন হয়ে পড়ল।
এ বিষয়ে মনিরুল হক বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন আর স্থানীয় নির্বাচন এক না। গতবার অনেকে আমাকে এমপি ইলেকশন করতে কইছে, করি নাই। যদি করতাম, বেইমান হতাম। স্থানীয় সরকারে ভোট না করলে কর্মী-সমর্থকেরা ছুটে যায়। আমি নির্বাচন করতাছি, তাগো ধইরা রাখার জন্য, আর কুমিল্লায় যারা স্বাধীনভাবে চলতে চায়, তাগো জন্য।’
অন্যদিকে নির্বাচনের পর নিজামউদ্দিনের মূল্যায়ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখা যায় না। তিনি বলেন, ‘আমার চিন্তা ছিল, সরকার সংসদ নির্বাচনটা একপেশে করে বিতর্কিত হয়েছে। কুমিল্লার নির্বাচন হয়তো ফেয়ার (পক্ষপাতমুক্ত) হবে। কিন্তু এবার তারা নতুন ফর্মুলা নিয়েছে, কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাহারা বসিয়ে ভোটার নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাদের ওপর আস্থা রাখা কঠিন।’
prothomasha.com
Copy Right 2023