ইফতারে অন্তত দুইটা খেজুর আর এক গ্লাস শরবত মুখে তুলতে হয় রোজাদারকে। তবে সেই ন্যূনতম ইফতারি পণ্যেরই বেজায় দাম। খেজুরে এবার হাতই দেওয়া যাচ্ছে না, চিনির দামেও লম্ফঝম্প। আর শরবতের জন্য লেবু! এখনই আগুন দাম। রোজায় এক লেবু কত টাকা দিয়ে সদাই করতে হবে, সে চিন্তায় কপালে ভাঁজ ফেলছেন ক্রেতা।এবার সেহরিতে আসা যাক। রোজা শুরুর আগেই ব্রয়লার ও সোনালি মুরগি দেখাচ্ছে দামের তেজ। গরুর মাংস কেজিতেই বেড়ে গেছে অন্তত ১০০ টাকা। সব মাছের দামও বাড়বাড়ন্ত। শুধু খেজুর, চিনি, লেবু, মাছ-মাংস নয়; বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দরই বল্গাহীন। রমজান শুরুর পাঁচ-ছয় দিন আগে পণ্যের দরের এমন উড়াল গতিই বলে দিচ্ছে, এবার হবে আরও খরুচে রোজা।
গতকাল বৃহস্পতিবার হাতিরপুল কাঁচাবাজারে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী মাইনুল ইসলামের সঙ্গে। ছোলা, চিনিসহ রোজার কয়েক পদের পণ্য কিনতে গিয়ে তিনি বেশ ক্ষুব্ধ। বললেন, ‘প্রতিবছর রোজার আগে সরকার বলে শুল্ক কমানো হয়েছে, দাম কমবে। তবে যারা বাজার করে, তারা জানে বাজারে কী হচ্ছে। শুধু মুখে বলে দিলে হয় না; কার্যকর করতে হয়।’ রোজায় পণ্যের দামের লাগাম টানতে সরকার গত ৮ ফেব্রুয়ারি খেজুর, চিনি, সয়াবিন তেল ও চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছিল। তবে সয়াবিন তেল ছাড়া অন্য তিন পণ্যের শুল্ক ছাড়ে সরকারের টোটকা কাজে দেয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বাজার এখন অনেকটাই অস্থির। মূল্যস্ফীতিও বেশি। করোনার পর বিশ্বের অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা কার্যকর পদক্ষেপ নিলেও বাংলাদেশ ছিল অনেক পিছিয়ে। ফলে করোনার সময় যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল, তার আঁচ এখনও রয়ে গেছে। এ পটভূমিতে রোজা কিংবা ঈদের আগে তড়িঘড়ি করে নেওয়া এসব পদক্ষেপ খুব একটা কাজে আসে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে যথাসময়ে। বদলাতে হবে বাজার ব্যবস্থাপনা, বাড়াতে হবে প্রতিযোগীর সংখ্যা। তাহলে ভোক্তা ঠিক সময় কিছুটা হলেও সুফল পাবেন।
বেশি ভোগাবে খেজুর
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য বলছে, দেশে বছরে খেজুরের চাহিদা এক লাখ টনের। শুধু রমজানেই দরকার হয় ৫০ হাজার টন। রোজায় চাহিদা বেশি থাকায় দরও বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। তবে এবার ব্যবসায়ীদের সেই অপচেষ্টার সঙ্গী উচ্চ শুল্ক। ফল আমদানিকারকদের দাবি, ১০ শতাংশ কমালেও এখনও সাধারণ মানের প্রতি কেজি খেজুরে শুল্ক পরিশোধ করতে হয় ১৫০ টাকার মতো। বাজারে এখন এক কেজি সাধারণ মানের (জায়েদি) খেজুরের দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। গত বছর রোজার আগমুহূর্তে এ ধরনের খেজুরের কেজি ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। সে হিসাবে এবার প্রতি কেজি খেজুর কিনতে ক্রেতাকে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে ২০০ টাকা। শুধু খেজুর নয়, সব ফলের দরই চড়া।ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিলাসী পণ্যে অন্তর্ভুক্ত করায় খেজুর আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রয়েছে। কাস্টমস ইচ্ছামতো খেজুরের আমদানিমূল্য বেশি ধরে শুল্কায়ন করছে। বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি খেজুরে সর্বনিম্ন ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দর বেড়েছে।
ছোলা-চিনিতেও খরচ বাড়ল
বছরে চিনির চাহিদা ২২ লাখ টন। শুধু রোজায় দরকার হয় তিন লাখ টন। দেশে চিনি উৎপাদন হয় ৩০ হাজার টনের মতো। বাকিটা আমদানি করে মেটাতে হয়। গত বছর এ সময় প্রতি কেজি চিনি কেনা গেছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। গতকাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়, অর্থাৎ চিনির কেজিতে অতিরিক্ত খরচ হবে ২৫ থেকে ৩০ টাকা।
বছরে প্রায় দুই লাখ টন ছোলা আমদানি হয়। রোজায় দরকার হয় এক লাখ টন। গত বছর বাজারে এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১২ টাকা দরে। সে হিসাবে এবার কেজিতে বেশি খরচ করতে হবে ১৫ থেকে ১৭ টাকা। গত বছর রোজার আগে অ্যাংকর ডালের কেজি ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। এবার তা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়।এখনই মাঝারি আকারের একটি লেবুর দাম হাঁকা হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা। তিন দিনের ব্যবধানে কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে শসা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে।
পেঁয়াজের দর তিন গুণ
পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৫ লাখ টনের। উৎপাদনের পাশাপাশি ৮ থেকে ৯ লাখ টন আমদানি করতে হয়; যার সিংহভাগ আসে ভারত থেকে। ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় দেশে এখন আমদানি হচ্ছে না বললেই চলে। ফলে এখন দেশি পেঁয়াজের ওপর পুরোপুরি নির্ভর বাজার। তাতে দামও বেশ চড়া। গত বছর রোজার আগে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সেই দাম এখন প্রায় তিন গুণ। প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২৫ টাকা দরে। সে হিসাবে কেজিতে বেশি খরচ হবে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।রোজায় চপসহ ইফতারির নানা পদ বানানো হয় আলু দিয়ে। ফলে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে রোজায় চাহিদা থাকে বেশি। গেল বছর আলু বেশি ভুগিয়েছে ভোক্তাদের, যার রেশ ভরা মৌসুমেও কাটেনি। বাজারে এখন ভরপুর আলু। তবু কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা দরে। গত বছরের এ সময়ে কেজি ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। তাতে গত রমজানের চেয়ে এবার কেজিতে বেশি গুনতে হবে ১৪ থেকে ১৫ টাকা।
মাছ-মাংসেও আছে দুশ্চিন্তা
ব্রয়লার মুরগি এখনও গত বছরের দামকে ডিঙাতে পারেনি। যদিও গত দু’দিনের ব্যবধানে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। দু’দিন আগে কেজি ২০০ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৩৫ টাকায়। গত বছর এ সময় দর ছিল ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা। সোনালি জাতের মুরগির কেজি ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা ছিল এক বছর আগে, যা এখনই বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকায়।
তবে গত বছরের এ সময়ের দরকে ছাড়িয়েছে গরুর মাংস। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকায়। গত বছর রোজার আগে ছিল ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা, অর্থাৎ ভোক্তাদের এবার গরুর মাংসের কেজিতে অতিরিক্ত গুনতে হবে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।জাতীয় নির্বাচনের আগে গরুর মাংসের দাম কমায় মাছের বাজারেও কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল। রোজার আগে আগে মাছের বাজারও গরম। পাঙাশ, কই, রুই, কাতলাসহ প্রায় সব ধরনের মাছের কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। ডিমের দামও গত বছরের তুলনায় কিছুটা বাড়তি। প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়।
তবুও চালের দর বেশি
চালের বাজারেও সুখবর নেই। জাতীয় নির্বাচনের আগে হঠাৎ চালের বাজার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকারের নানা পদক্ষেপে কিছুটা কমলেও গত বছরের চেয়ে দর বেশি। গত বছর এ সময় মোটা চালের কেজি ৪৬ থেকে ৫০ টাকা ও চিকন চালের কেজি ৬০ থেকে ৭৫ টাকা ছিল। এখন দুই রকমের চালের দর যথাক্রমে ৪৮ থেকে ৫২ ও ৬২ থেকে ৭৫ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে প্রায় দুই টাকা বেশি। তবে মাঝারি মানের চালে তেমন হেরফের নেই।
কিছুটা স্বস্তি ভোজ্যতেলে
কিছুটা সুখবর ভোজ্যতেলে। ভোজ্যতেলের বার্ষিক ২০ লাখ টন চাহিদার মধ্যে রোজায় প্রয়োজন হয় তিন লাখ টন। গত বছরের চেয়ে এবার ভোজ্যতেলের দর কিছুটা কম। গত বছর এ সময় খোলা সয়াবিনের লিটার ছিল ১৬৮ থেকে ১৭২ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫২ থেকে ১৫৮ টাকা। সে হিসাবে লিটারে খরচ কমবে ১৪ থেকে ১৬ টাকা। যদিও বিশ্ববাজারে এখন তেলের দর অনেক কম।দেশে বেশি হলেও কয়েকটি পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে এখন তুলনামূলক কম। ট্যারিফ কমিশনের গত সপ্তাহের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিশ্ববাজারে গত বছরের এ সময় প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনির দর ছিল ৫০ টাকা। সামান্য বেড়ে গত সপ্তাহে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৪ টাকায়। ছোলার কেজি ৭৩ থেকে বেড়ে ৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে গত বছরের এ সময় প্রতি লিটার সয়াবিন ও পাম অয়েলের দর ছিল যথাক্রমে ১২৭ ও ১০৯ টাকা; যা গত সপ্তাহে নেমেছে যথাক্রমে ৯১ ও ৯৬ টাকায়। একইভাবে গত বছরের এ সময়ের ৪০ টাকা কেজির গম কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ টাকায়।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকার শুল্ক কমানোসহ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে কথায় আছে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। ইতিবাচক পদক্ষেপ সময়মতো নেওয়া হয়নি। যথাসময়ে নিলে ভোক্তা এখন সুফল পেতেন।তিনি বলেন, ডলারের দর বাড়ার একটা প্রভাব রয়েছে পণ্যমূল্যে। অন্যদিকে যখন মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, তখন ভোক্তারা নিজের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এটা করতে গিয়ে একে অপরের ওপর সেই বোঝা চাপিয়ে দেন। যেমন– বাড়িওয়ালা তাঁর ভাড়াটিয়াদের ভাড়া বাড়িয়ে দেন। রিকশাচালক তাঁর আগের ভাড়া ২০ টাকার জায়গায় ৩০ টাকা নিতে চাইবেন। ব্যবসায়ীরাও নিজেদের মূল্যস্ফীতির বিষয় মাথায় নিয়ে পণ্যের দর আরও বাড়িয়ে দেন। এভাবেই মূল্যস্ফীতি ভোক্তাকে নিঃশেষ করে দেয়। কারণ যে দামে পণ্য উঠে যায়, সেই দাম থেকে আর নামে না।
সরকার টিসিবি ও ওএমএসের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য দিচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ। এ ধরনের আরও নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি।বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও ৯ শতাংশের বেশি রয়েছে। এটি খুব স্বাভাবিক নয়। তাঁর মতে, বাজার ব্যবস্থাপনায় কিছুটা ত্রুটি আছে। ফলে শুল্ক কমানোর সুফল দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ, বাজারে মূলত পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, অর্থাৎ প্রতিযোগী কম। স্বল্প কয়েকজন আমদানিকারক বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা যে দর নির্ধারণ করেন, সেই দরে বাজার চলে। অন্যদিকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কম হওয়ায় সরকারও কিছুটা চিন্তায় থাকে। কারণ সরকার ভাবে, আমদানিকারকদের চাপ দিলে তাতে তারা আমদানি বন্ধ করলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই আমদানিকারক বাড়াতে হবে।
বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে ড. গোলাম মোয়াজ্জেমের পরামর্শ, পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ও মজুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পুরো প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল করা দরকার। তবে প্রতিবছর রোজা বা ঈদ ঘিরে স্বল্প সময়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার অযাচিত চেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিকল্পনা নিতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে। আমদানি-নির্ভরতা কমানো, উৎপাদন বাড়ানো ও যথাযথ তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর দাবি– সংকট হবে না চিনির
এদিকে, গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেছেন, দেশজুড়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে টিসিবি কার্ডধারীর তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। চিনি নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, টিসিবির চিনি আগের দামে (কেজি ৭০ টাকা) বিক্রি হবে, দাম বাড়ানো হবে না। পর্যাপ্ত চিনি মজুত আছে। বাজারে কোনো সংকট হবে না।
prothomasha.com
Copy Right 2023