জাবি আলোনসোর সাহসটা দেখেছেন! মাঝারি মানের ক্লাবও নয়, একেবারে ইউরোপিয়ান ফুটবলের ‘ত্রিমুকুট’—রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ ও লিভারপুল। এই তিন ক্লাব একসঙ্গে কাউকে কোচ হিসেবে পেতে চাইলে তিনি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। অথচ জাবি কিনা সেই সৌভাগ্যই পায়ে ঠেললেন! মাত্র ৪২ বছর বয়সী একটা মানুষ। তাঁর বয়সের কাছাকাছি দু-একজনকে এখনো ফুটবল মাঠে দেখা যায়। আর কোচ হিসেবে অভিজ্ঞতাও বেশি দিনের নয়। রিয়াল সোসিয়েদাদের ‘বি’ দল এবং বায়ার লেভারকুসেন মিলিয়ে মাত্র পাঁচ বছর।
লেভারকুসেনে এ মৌসুমে জাবির সাফল্য ভুলে একবার ভাবুন তো, এত অল্প অভিজ্ঞতার কাউকে ইয়ুর্গেন ক্লপ, কার্লো আনচেলত্তি কিংবা টমাস টুখেলের জায়গায় ভাবা যায় কি না! ভাবা গেলে জাবির ওপর পূর্ণ আস্থা রাখায় আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, জাবি নিজেই নিজেকে ওই জায়গায় ভাবেননি। প্রশ্ন হলো, কেন? এটা কি শুধুই দুঃসাহসীসুলভ বোকামি, নাকি সত্যিই জাবির এই ‘না’ করার পেছনে কিছু একটা আছে? সেটা হতে পারে তাঁর আদর্শগত চিন্তাভাবনা কিংবা নিজেকে আরেকটু ভালোভাবে প্রস্তুত করে তারপর বড় কিছু ভাবা। ব্যাপারটা যা-ই হোক, সেটা বুঝতে জাবির ফেলে আসা পথে তাকাতেই হয়।
নভেম্বর ২০১৯। সান সেবাস্তিয়ান। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। জানালা দিয়ে আবহাওয়াটা একঝলক দেখে জাবি ফিরলেন নিজের কাজে। ‘দ্য অ্যাথলেটিক’-এর সংবাদকর্মীকে বোঝাচ্ছিলেন, কেন তিনি নিজের জায়গাতেই খুশি। তত দিনে অবসর নেওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেছে। কোচ হিসেবে হাত পাকানোর চেষ্টা করছিলেন সোসিয়েদাদ ‘বি’ দলে। এই দলেই একসময় বেড়ে উঠেছেন কিশোর জাবি। এই সান সেবাস্তিয়ানোর মাঠ অ্যানোয়েতায় জাবির শিকড় পোঁতা। ফুটবল নিয়ে জীবনের নতুন অধ্যায়ে মৌলিক বিষয়াদি ভালোভাবে শিখতে জাবি বেছে নিয়েছিলেন নিজের শৈশবের ক্লাবকে, যেখানে তিনি একদম চাপহীন থেকে সব শিখেপড়ে নিতে পারবেন। রিয়াল অনূর্ধ্ব-১৪ দলেও কাজ করেছেন জাবি। গুঞ্জন ছিল, ম্যানচেস্টার সিটিতে পেপ গার্দিওলার দলের কোচিং স্টাফে যোগ দিতে পারেন। কিন্তু জাবি ভেবে রেখেছিলেন অন্য কিছু।
এত বছর ধরে মাদ্রিদ, লিভারপুল, মিউনিখ ঘোরার পর জাবি একটু থিতু হয়ে চাপহীন থেকে নিজেকে কোচ হিসেবে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন। পরিবারকে চেনাতে চেয়েছিলেন সান সেবাস্তিয়ান, যে শহর তাঁকে গড়েপিটে আজকের জাবি আলোনসো বানিয়েছে। কোচিংয়ের মৌলিক বিষয়াদি শিখতে থাকতে চেয়েছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। আর টাকাপয়সা নিয়েও ভাবনা ছিল না। বিশ্বকাপ, ইউরো, চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং দুটি দেশে লিগ জেতা ক্যারিয়ারে টাকাপয়সা তো কম কামাননি! তাই বড় কোথাও যোগ দিয়ে দাঁও মারা নয়, জাবি তাকিয়েছেন সুদূরে। সেই দৃষ্টি কত দূরে, সেটি মেপে নেওয়া যায় তাঁর কথায়, ‘আমি কী করেছি, সে জন্য মানুষের কাছে পরিচিত হতে চাই না। আমি কী করছি, সেটার জন্য পরিচিত হতে চাই।’
জাবি এখন কোচ। অর্থাৎ বর্তমানের এ পেশায় তিনি পরিচিতি পেতে চান। সে জন্য তাঁর প্রস্তুতির ধরন দেখেই বোঝা যায়, দু-এক মৌসুমের ‘ফ্লুক’ নয়, টেকসই পরিচিতিই চান তিনি। আর সে জন্যই তিনি অনেক কিছু ছেড়ে আসা মানুষ, অনেক কিছু ছেড়ে দেওয়া ব্যক্তিত্বও। যেমন ২০২২ সালে লেভারকুসেনে যোগ দেওয়ার আগে বরুসিয়া মনশেনগ্লাডবাখে যোগ দিতে পারতেন। ওরা একটু অপেক্ষা করতে বলেছিল। জাবির মনে হয়েছিল, টাইমিংটা ঠিক হচ্ছে না। তাই আর যাননি। থেকে গেছেন সান সেবাস্তিয়ানেই। বিশ্বাস ছিল, যেমন সুযোগ চান, তেমন কিছু আসবেই।
লেভারকুসেনে সেই সুযোগ পেয়েছেন। তারপর? ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের এবারের মৌসুমে লেভারকুসনকে এখনো কেউ হারাতে পারেনি। ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম লিগ শিরোপাটাও এবার জয়ের পথেই আছে লেভারকুসেন। ৭ ম্যাচ হাতে রেখে শীর্ষে থাকা লেভারকুসেনের সঙ্গে ১৩ পয়েন্ট ব্যবধানে পিছিয়ে বায়ার্ন কোচ টমাস টুখেল আগেভাগেই ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছেন জাবিকে। এরপর যখনই গুঞ্জন উঠল, মৌসুম শেষে তাঁকে কোচ হিসেবে পেতে চায় লিভারপুল, রিয়াল ও বায়ার্ন—জাবি একটু সময় নিয়ে তিনটি ক্লাবকেই না করে দিলেন। সিদ্ধান্তটা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, তিনটি ক্লাবেই খেলোয়াড় হিসেবে দারুণ সময় কেটেছে তাঁর, অর্থাৎ রিয়াল সোসিয়েদাদের মতো এই ক্লাবগুলোরও সবকিছুই তাঁর চেনাজানা। তাহলে?
জাবির জীবনে কিন্তু ফুটবল আগে আসেনি। পড়াশোনা ছিল সবার আগে। সে জন্য শৈশব কেটেছে আইরিশ শহর কেলসে। আরেকটু বড় হওয়ার পর সান সেবাস্তিয়ানে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির জন্য ভর্তি হন। তখন আবার তিনি ফুটবলারও। অথচ মাথায় ছিল অর্থনীতিতে ক্যারিয়ার গড়ার ভাবনা। তার আগেই ডাক পড়ে সোসিয়েদাদের মূল দল থেকে। কিংবা লিভারপুলের সে দিনগুলো, সেখানকার ছাত্রসমাজেও মিশে যেতেন জাবি। তাঁর জীবনটা আর দশজন তারকা ফুটবলারের মতো ছিল না। বিয়ে করেছেন অনেক দিনের প্রেমিকা নাগোরেকেই। যেকোনো বিষয়ে নিজের খামতি বা ঘাটতিকে স্বীকার করে নেওয়া জাবির ব্যক্তিত্বের অন্যতম বড় শক্তি, অলংকারও। কোচ হিসেবে নিজেকে তিনি সম্ভবত লিভারপুল-বায়ার্নের মতো ক্লাবের দায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করেননি, অন্তত এখন পর্যন্ত। এই ঘাটতিটুকু মনে মনে মেনেই সম্ভবত ওই সিদ্ধান্ত।
কিংবা মনের এই যে বিশ্বাস, সেখানে অটল থাকতে পারাও একটা ব্যাপার। ২০০৮ সালের দিকে তাঁকে বেচে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন লিভারপুল কোচ রাফায়েল বেনিতেজ। প্রথম সন্তানের মুখ দেখতে চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ ষোলো ফিরতি লেগে খেলেননি জাবি। বেনিতেজ চটেছিলেন তাঁর ওপর। কিন্তু জাবি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। যেমন অনড় অবস্থান দেখিয়েছেন তিনটি ক্লাবকে ‘না’ করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও।
বুট তুলে রাখার পর জাবি একটু লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। তখন ভেবেছেন, কোচিংয়ে নামা যায় কি না। তত দিনে তাঁর ক্লাব সতীর্থদের (স্টিভেন জেরার্ড, মিকেল আরতেতা) কেউ কেউ বড় বড় ক্লাবের কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন। আর জাবি ভেবেছেন আরেকটু গভীরে। পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে তবেই বড় কোনো ক্লাব...। তার আগে জাবি এই মধ্যবর্তী সময়ে নিজের কোচিং-সত্তাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, ভুলগুলো শুধরেছেন, কীভাবে শোধরাতে হয়, সেসবও জেনেছেন এবং এখনো সেই প্রক্রিয়া চলছে। লেভারকুসেনের কথাই ধরুন। জাবি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, ক্লাবটি তখন ১৮টি দলের লিগ টেবিলে ১৭তম স্থানে ধুঁকছিল। সেই ভুল অবস্থান শুধরে জাবির হাত ধরে লেভারকুসেন এখন চলতি মৌসুমে টানা ৩৯ ম্যাচে অপরাজিত!
খাদহীন, অর্থাৎ সবকিছু গোছানো এবং নির্ভুল থাকার চেষ্টাটা জাবির স্বভাবজাত। লেভারকুসেনের দায়িত্ব নিয়ে যেমন দলটির রক্ষণভাগের ছকে পাঁচ খেলোয়াড় ফিরিয়ে জায়গাটা আঁটসাঁট করেছেন। উইথ দ্য বল এবং অব দ্য বল মুভমেন্টেও লেভারকুসেন এখন অনেক বেশি দক্ষ। সব মিলিয়ে গতি ও বল দখলে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করেছে জার্মান ক্লাবটি। অনুশীলনেও সবকিছু নিজে বুঝিয়ে দিতে জাবি খেলোয়াড়দের সঙ্গেও মাঠে নেমে পড়েন। লেভারকুসেন লেফট উইং-ব্যাক অ্যালেক্স গ্রিমালদোর মুখেই শুনুন, ‘সে খুব সহজেই এখনো খেলতে পারে। খুব কম খেলোয়াড়ই তার মতো পাস দিতে পারে।’ মিডফিল্ডার গ্রানিত শাকার ভাষায়, ‘সে আমাদের কিছু খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি দৌড়ায়।’
এই যে সবার আগে নিজেকে প্রস্তুত করা, কোচ হয়েও অনুশীলনে সবকিছু নিজের হাতে দেখিয়ে দেওয়ার প্রবণতা—এমন চরিত্রের কোচরা একটু আলাদাই হন। জাবিও তা–ই। লিভারপুলের হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার জিততে না পারার আক্ষেপ আছে জাবির। ইয়ুর্গেন ক্লপ মৌসুম শেষেই লিভারপুল ছাড়বেন। জাবি চাইলেই লিভারপুলকে ‘হ্যাঁ’ বলে প্রিমিয়ার লিগ জিততে না পারার দুঃখ মোচনের চেষ্টাটা আরও একবার করতে পারেন। কিন্তু তাঁর মনই তাঁকে বলেছে, সেই সময় এখনো আসেনি। তুমি এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নও!
আর তাই গত ১৮ মাস নিজের জার্মান-জীবন নিয়ে জাবির উপলব্ধি, ‘আমি এমন পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে নিজেকে স্থিতিশীল এবং সুখী মনে করি।’ জাবির পরের কথাটা গুরুত্বপূর্ণ, ‘কোচ হিসেবে বেড়ে উঠতে এটাই আমার জন্য সঠিক জায়গা।’ কোচ হিসেবে বেড়ে ওঠা—জাবিকে চিনতে এই কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ এখনো নিজেকে পরিপূর্ণ কোচ তিনি মনে করেন না। বড় দলের দায়িত্ব নেওয়া তো আরও পরের ব্যাপার। এখনো যে তাঁর শেখার পাতাগুলো শেষ হয়নি। দাঁড়ানো হয়নি চ্যাম্পিয়নস লিগের ডাগআউটেও। অলৌকিক কিছু না ঘটলে লেভারকুসেন কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগের আগামী মৌসুমে ডাগআউটে দাঁড়াবেন জাবি। সেই মৌসুম শেষে কি তাঁর কোচ হিসেবে বেড়ে ওঠার সমাপ্তি ঘটবে? জাবি কি তারপর আরও বড় কোনো দলের পানে তাকাবেন? উত্তরটা শুধু জাবিই জানেন। তাঁর প্রস্তুতি কবে শেষ হবে, সেটা যে কেউ জানেন না! তবে এটা নিশ্চিত, নিজেকে প্রস্তুত মনে করলেই কেবল জাবির ঠিকানা পাল্টাতে পারে, তার আগে নয়, সেটা যে দলই হোক!
prothomasha.com
Copy Right 2023