ভেজাল অ্যানেসথেসিয়া ওষুধে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বসানোর সময় তিন শিশুকে অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়। বিজ্ঞান গবেষণাগারে পরীক্ষা করে প্রমাণিত হয়েছে যে তারা অ্যানেস্থেশিয়ার ওষুধ হিসেবে 'হ্যালোথেন' ব্যবহার করেছে। কিন্তু ওই ওষুধে কোনো হ্যালোথেন ছিল না। অর্থাৎ এটা ভেজাল। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে এ প্রতিবেদন আসে। এ কারণে গতকাল জরুরি বৈঠকে বসে স্বাস্থ্য প্রশাসন। সেখানে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত ওষুধ পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালকে অপারেশন থিয়েটারে 'ইনহেলেশনাল অ্যানেস্থেটিক' হিসাবে 'হ্যালোথেন'-এর পরিবর্তে 'আইসোফ্লুরেন বা সেভোফ্লুরেন' ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার, স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদপ্তর এই বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তিতে অ্যানেস্থেসিয়া সংক্রান্ত মৃত্যু এবং এর অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।
তবে এর আগেও সারাদেশে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অপারেশনের সময় অনেক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। হ্যালোথেনের কারণে এই ভেজাল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি গত বছরের 23 এপ্রিল থেকে হ্যালোফেনের উত্পাদন এবং বিপণন বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের এসিআই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এই ওষুধ তৈরি করত, যার নাম ছিল হ্যালোসিন। তারা এক বছরের জন্য এর উৎপাদনও বন্ধ করে দেয়। তবে এই হ্যালোথান পাচার হয় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে। যা ভেজাল ও নকল। এ কারণে খতনা করাতে গিয়েও শিশুটির মৃত্যু হয়। রোগীকে অজ্ঞান করতে ওষুধ হ্যালোথেন ব্যবহার করা হয়। Isoflurane এবং sevoflurane রোগীকে চেতনানাশক করার জন্যও ব্যবহার করা হয়। এগুলো বিভিন্ন ওষুধ হলেও মূল কাজ হলো রোগীকে অচেতন করা। একটি বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে ওষুধ শরীরে প্রবেশ করানো হয় এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সম্প্রতি ঢাকা ইউনাইটেড হাসপাতালে শিশু আয়ান আহমেদ এবং মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে আহনাফ তাহমিদ আলম আইহাম নামে দুই শিশু খতনার জন্য অচেতন অবস্থায় মারা যায়। ওই দুই শিশুর মৃত্যুর পর দেশে সঠিকভাবে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন সামনে আসে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অবশেষে নড়েচড়ে বসেছে স্বাস্থ্য দফতর। যারা এটি ব্যবহার করে তারাই বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। শোকার্ত পরিবারের একমাত্র রুটি উপার্জনকারী অর্ধাহারে বঞ্চিত ও অনাহারে দিনযাপন করছেন। এগুলো দেখভালের দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। এছাড়াও, যত্ন নেওয়ার জন্য অনেক আছে। তারপরও ভেজাল হ্যালোথানে এত মানুষ মারা গেছে। খতনা করানোর সময় তিনি মারা যান। ভেজাল হ্যালোথেনের কারণেই এমনটা হয়েছে। সেটা গতকালই প্রমাণিত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশে টিম পাঠিয়েছে তদন্ত করে দেখেছে যে সার্জনরা ভালো আছেন, অ্যানেস্থেসিওলজিস্টরা ভালো আছেন এবং অপারেশন থিয়েটার ভালো আছেন। তাহলে রোগী মারা গেল কেন? তারা কিছুই খুঁজে পায়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শিশুর মৃত্যুর পর অ্যানাস্থেসিওলজিস্টদের সোসাইটি ওষুধ হ্যালোথেন পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞান পরীক্ষাগারে পাঠায়। গতকাল তারা প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে চেতনানাশকটিতে কোনও হ্যালোথেন ছিল না। গতকাল বিএসএমএমইউতে এ প্রতিবেদন আসে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের সোসাইটিও একই রিপোর্ট করেছে। সাধারণত পাচার করা ভেজাল হ্যালোথেন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ব্যবহার করা হয়। সরকারি হাসপাতালে ব্যবহার করা হয় না। হ্যালোথেন 80 থেকে 90 বছর ধরে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গত বছর ধরে বিশ্বব্যাপী এটি আর ব্যবহার করা হয় না। এখন নতুন ওষুধ আইসোফ্লুরেন। আমাদের দেশে হ্যালোসিন উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল ভারত থেকে এসেছে। গত এক বছর ধরে আসছে না। এদিকে, নতুন ওষুধ আইসোফ্লুরেন ব্যবহার করার মেশিনটি ভিন্ন। নতুন ওষুধ ব্যবহারের জন্য মেশিনের কিছু অংশ বদলাতে হবে। অনেকেই করে না। আইসোফ্লুরেন ব্যবহার করার মেশিনটির নাম ভ্যাপোরাইজার। এর দাম দুই লাখ টাকার বেশি। এ কারণে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক তা কেনে না। এর বদলে ব্যবহার করুন ভেজাল হ্যালোথেন। এ কারণে প্রতিদিনই ঘটছে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা। প্রতিটি আসল হ্যালোথেনের দাম 200 থেকে 300 টাকা। আর আইসোফ্লুরেনের দাম ৬০০ টাকা।
অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের সোসাইটি সম্প্রতি লিখিতভাবে রিপোর্ট করেছে যে অ্যানেস্থেশিয়া ওষুধের ব্যবহারে অমিল রয়েছে। এ জন্য তারা সরকারকে এর ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট আদেশ জারি করার সুপারিশ করেছে। হ্যালোথেন ব্যবহার করলে আসল হ্যালোথেন ব্যবহার করুন। তবে হ্যালোথেন বা আইসোফ্লুরেন যেটিই ব্যবহার করা হোক না কেন, এর ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন থাকতে হবে। গতকাল বিএসএমএমইউতে সামন্ত লাল সেনের নেতৃত্বে এক জরুরি বৈঠকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা.রোকেয়া সুলতানা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. অন্যান্য উপস্থিত ছিলেন। অ্যানেস্থেশিয়ার ওষুধ হিসেবে আইসোফ্লুরেন ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ডিগ্রিধারী ডাক্তার ছাড়া আর কেউ অ্যানেসথেসিয়া দিতে পারে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। লেখা চিঠিগুলো অনেকদিন পেছনে পড়ে থাকে। মন্ত্রণালয়ের এই অবহেলায় কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে কেউ জানে না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ সামন্ত লাল সেন বলেছেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া অসচেতনতার জন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। কেউ ব্যবহার করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী হাসপাতাল পরিচালনা করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, এখন থেকে অ্যানেসথেসিয়ায় হ্যালোথেন ব্যবহার করা যাবে না। আইসোফ্লুরেন ব্যবহার করা উচিত। একটি vaporizer এছাড়াও উপস্থিত থাকা উচিত. ডিগ্রিধারী ডাক্তার ছাড়া আর কেউ অ্যানেসথেসিয়া দিতে পারে না। সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে এই আদেশ পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি অধ্যাপক ড. দেবব্রত ভণিক বলেন, হ্যালোথেন এবং আইসোফ্লুরেন এবং সেভোফ্লুরেন একই ওষুধ। তবে হ্যালোথেনের দাম একটু কম হওয়ায় ওষুধ বেশি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব কোম্পানি হ্যালোথেন আমদানি করত তারা এখন তা করছে না। তাই বাজারে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা ৪০ বছর ধরে হ্যালোথেন ব্যবহার করে আসছি। কিন্তু যারা আনতেন তারা এখন আনছেন না। কিন্তু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে তা আমদানি করছেন। এটি অন্যান্য জিনিসের সাথে মিশিয়ে চড়া দামে বিক্রি করা হয়। সেজন্য আমরা এই ভেজাল ওষুধের ব্যবহার বন্ধের সুপারিশ করেছি। বরং বাজারে যা সহজলভ্য তাই ব্যবহার করা যেতে পারে।
নির্দেশনায় যা আছে: স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের যুগ্ম সচিব জসিম উদ্দিন হায়দার স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কিছু রোগীর মৃত্যু ও আকস্মিক জটিলতা রোধে অ্যানেসথেসিয়ায় হ্যালোজেন ব্যবহার ও এর বিকল্প ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে। অ্যানেস্থেশিয়া এবং ব্যবহৃত ওষুধের গুণমান নিশ্চিত করতে। এছাড়া অ্যানেসথেসিয়াজনিত মৃত্যু ও ওষুধের অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে হ্যালোথেন, আইসোফ্লুরেন, সেভোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজারের সংখ্যা এবং আইসোফ্লুরেন, সেভোফ্লুরেন ভেপোরাইজারগুলির সাথে এই ভেপোরাইজারগুলি প্রতিস্থাপনের জন্য তহবিল বরাদ্দ করা উচিত। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া হ্যালোজেন বিক্রি ও ব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি অ্যানেস্থেসিস্টদের (অ্যানেস্থেসিস্ট) সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী বর্তমানে ব্যবহৃত হ্যালোথেন ভেপোরাইজারকে আইসোফ্লুরেন ভেপোরাইজার দিয়ে প্রতিস্থাপন করার জন্য সব সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নতুন মেশিনের স্পেসিফিকেশন কেনার ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে আইসোফ্লুরেন, সেভোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
prothomasha.com
Copy Right 2023